দেশি মুরগি পালনের সম্পূর্ণ গাইডলাইন।

দেশি মুরগির খামার অল্প টাকায় বেশি আয় করা যায়।

 দেশি মুরগি খামার: অল্প টাকায় বেশি আয় করা যায়।

এম আল-আমিন 
প্রকাশঃকৃষক🔆কৃষি

দেশি মুরগি খামার
[ফাইল ছবি- দেশি মুরগি খামার]

বর্তমান সময়ে কৃষি ও পোল্ট্রি খামার ব্যবসা দিন দিন আরও লাভজনক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে দেশি মুরগি খামার, যা কম খরচে শুরু করা যায় এবং দ্রুত লাভ প্রদান করে।দেশি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি হয়। দেশে দেশি মুরগির চাহিদা ক্রমবর্ধমান, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসম্মত, রাসায়নিকমুক্ত মাংস ও ডিমের জন্য। সঠিক পরিকল্পনা ও যত্নের মাধ্যমে আপনি বছরে লাখ টাকা আয় করতে পারেন।

দেশি মুরগির পুষ্টিগুণ-

দেশি মুরগি সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে বড় হয়, ফলে এতে কোনো কেমিক্যাল বা হরমোন ব্যবহার করা হয় না। এর মাংসে প্রোটিন বেশি, চর্বি কম।
নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিগুণ দেওয়া হলোঃ

  • উচ্চ মানের প্রোটিন: শরীরের পেশী গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

  • কম ফ্যাট ও কোলেস্টেরল: হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

  • ভিটামিন বি ও আয়রন: রক্তশূন্যতা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

  • সহজ হজমযোগ্য: শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের। 


 দেশি মুরগি খামার করা উচিত কেন?

দেশি মুরগি খামার শুধুমাত্র মুনাফা নয়, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সফল ব্যবসা। এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করা হলো-

  1. কম খরচে শুরু করা যায়:

    দেশি মুরগি খামার শুরু করতে খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। ছোট আকারের খামারও লাভজনক হতে পারে।২০ থেকে ৩০ টি মুরগি দিয়ে খামার শুরু করতে পারেন।

  2. বাজারে চাহিদা সবসময় থাকে:

    দেশি মুরগির মাংস ও ডিমের চাহিদা সব সময় থাকে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এবং স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যে এটি খুব জনপ্রিয়।

  3. স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য সরবরাহ করা যায়:

    রাসায়নিকমুক্ত দেশি মুরগি ও ডিম সরবরাহ করে আপনি গ্রাহকের আস্থা ও বাজার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে পারেন।

  4. দীর্ঘমেয়াদী ব্যবসা:
    একবার খামার স্থাপন করা হলে, নিয়মিত পরিচর্যা ও সঠিক বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এটি একটি স্থায়ী আয়ের উৎসে পরিণত হয়।


খামার শুরুর জন্য করণীয়-

দেশি মুরগি খামার শুরু করতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অনুসরণ করতে হবে।

১. জাত নির্বাচন

দেশি মুরগির সঠিক জাত নির্বাচন ব্যবসার সফলতার চাবিকাঠি। কিছু জনপ্রিয় জাত:

  • দেশি লাল মুরগি – দ্রুত বৃদ্ধি, ভালো মাংস এবং ডিম উৎপাদন।

  • সোনালী দেশি মুরগি – মাংসের জন্য বেশি উপযোগী।

  • কালো দেশি মুরগি – ডিম উৎপাদনে বিশেষভাবে ভালো।

জাত নির্বাচন করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, আপনি কি মূলত ডিম উৎপাদন করবেন নাকি মাংস বিক্রির উদ্দেশ্যে।


২. খামারের ব্যবস্থাপনা-

খামারের পরিবেশ মুরগির স্বাস্থ্য ও উৎপাদন ক্ষমতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

উন্মুক্ত পদ্ধতি দেশি মুরগির খামার।

উন্মুক্ত পদ্ধতি দেশি মুরগি খামার।



  • স্থান নির্বাচন: খোলা, বায়ু চলাচলের সুবিধা ও রোদ-ছায়া থাকা উচিত।
    শেড বা ঘর নির্মাণ: পর্যাপ্ত বাতাস, আলো ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
    পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: নিয়মিত ঘর পরিষ্কার রাখা মুরগিকে রোগমুক্ত হতে রক্ষা করা যায়।
    উন্মুক্ত পদ্ধতি:খামারে চারপাশ জাল দিয়ে আবদ্ধ করে সেখানে মুরগি ছেড়ে লালন-পালন করলে মুরগি সুস্থ-সবল থাকে।


৩. খাদ্য ও পানি সরবরাহ -

মুরগির সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা লাভ বাড়ানোর মূল উপায়।

  • প্রাথমিক খাদ্য: বাচ্চা মুরগির জন্য হাই পুষ্টিকর খাবার।

  • বয়স্ক মুরগির খাদ্য: ভিটামিন ও খনিজ যুক্ত খাবার।

  • পরিষ্কার পানি: মুরগির জন্য সর্বদা পরিষ্কার পানি সরবরাহ করতে হবে।

সঠিক খাদ্য ও পানি প্রদান করলে মুরগির বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং ডিম উৎপাদন বাড়ে।


৪. স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়মিত চিকিৎসা প্রদান-

মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত রাখতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে-

ভ্যাকসিনেশন: মুরগিকে নিয়মিত ভ্যাকসিন দিন।


মুরগির ভ্যাকসিনের নাম,ধরন ও প্রয়োগ সময়-

ক্রমিক রোগের নাম ভ্যাকসিনের ধরন প্রয়োগের সময়
নিউক্যাসল ডিজিজ (Ranikhet) লাইভ / ইনঅ্যাক্টিভ ৫–৭ দিন বয়সে
ইনফেকশাস বারসাল ডিজিজ (Gumboro) লাইভ ১৪–২১ দিন বয়সে
ইনফেকশাস ব্রঙ্কাইটিস (IB) লাইভ ৭ ও ২১ দিনে
মেরেকস ডিজিজ (MD) ইনজেকশন ১ম দিন (হ্যাচারিতে)
ফাউল পক্স লাইভ (উইং-ওয়েব পদ্ধতি) ৬–৮ সপ্তাহ বয়সে  
ফাউল কলেরা ইনঅ্যাক্টিভ ৮–১০ সপ্তাহ বয়সে
 
ILT (Laryngo Tracheitis) লাইভ ১২ সপ্তাহ বয়সে  
কলিব্যাসিলোসিস (E. coli) অটোভ্যাকসিন প্রয়োজনে

ভ্যাকসিন দেওয়ার নিয়ম ও যত্ন-

  1. ভ্যাকসিন ঠান্ডা স্থানে সংরক্ষণ করুন (২–৮° C তাপমাত্রায়)।

  2. বরফসহ কুলারে রাখুন, সূর্যের আলোয় রাখবেন না।

  3. পরিষ্কার ঠান্ডা পানি ব্যবহার করুন, ক্লোরিন বা ওষুধ মেশানো নয়।

  4. খোলার পর ১ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করুন।

  5. অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন, ভ্যাকসিনের আগে ও পরে ২৪ ঘণ্টা।

  6. রোগাক্রান্ত মুরগিতে ভ্যাকসিন দেবেন না

  7.  ভ্যাকসিন প্রয়োগের সময় সেইফটি বজায় রাখুন।

আরো পড়ুন

 বিশেষজ্ঞ পরামর্শ-

ভ্যাকসিনের পর ভিটামিন C ও ইলেক্ট্রোলাইট দিন।
★ সব ভ্যাকসিনের তারিখ ও নাম লিখে রাখুন খামারের রেকর্ডবুকে।
★ প্রয়োজনে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

  • পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ: খামারের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করুন।[বিশেষ করে বর্ষা ও শীতকালে পরিবেশের উপর ভিওি করে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে]

রোগমুক্ত মুরগি উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায় এবং ব্যবসায় লাভ বৃদ্ধি করে।


৫. বাজারের চাহিদা গবেষণা-

বাজারের চাহিদা ও মূল্য সম্পর্কে আগে থেকে জানলে লাভ নিশ্চিত করা যায়।

  • ডিম ও মাংস সরবরাহের মাধ্যম: স্থানীয় হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও গ্রাহকের সাথে চুক্তি করতে পারেন।

  • মূল্য পর্যবেক্ষণ: মৌসুম অনুযায়ী দাম ওঠানামা করে।

  • ডিমান্ড চাহিদা বিশ্লেষণ: কোন প্রকার মুরগির বেশি চাহিদা আছে তা আগে জানুন।


আয়ের সম্ভাবনা-

  • মুরগি সুস্থ-সবল রেখে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে আয়ের সম্ভাবনা বেশি।বিশেষ করে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মুরগির চাহিদা একটু বেশি হওয়ার কারণে দাম বৃদ্ধি হয়।ফলে খামারীরা আয়ের সুযোগ তৈরি করতে পারে।

টিপস-

  • ছোট খামার থেকে শুরু করুন, বাজার যাচাই করুন।

  • নিজের খামারের জন্য একটি নাম ও ব্র্যান্ড তৈরি করুন।

  • সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করুন, গ্রাহক বাড়ান।

  • স্থানীয় কৃষি দপ্তর বা পোল্ট্রি এক্সপার্টের পরামর্শ নিন।


সাফল্যের উদাহরণ

বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানা  রসুলপুর ইউনিয়ন বরভরা গ্রামের আল-আমিন অনেক ছোট খামার থেকে শুরু করে লাখ টাকার ব্যবসা গড়ে তুলেছে।প্রথমে ৫০-১০০টি মুরগি দিয়ে শুরু করেছে এবং সঠিক পরিচর্যা ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যে বড় খামার প্রতিষ্ঠা করেছে।

দেশি মুরগি খামার বিষয়ক প্রশ্ন উওর-

প্রশ্ন ১: কত টাকায় দেশি মুরগি খামার শুরু করা যায়?
উত্তর: ছোট পরিসরে (৫০–১০০ মুরগি) খামার শুরু করতে ৩০,০০০–৫০,000 টাকায় সম্ভব। মাঝারি আকারের (২০০–৫০০ মুরগি) খামারের জন্য প্রায় ১–২ লাখ টাকা বিনিয়োগ লাগে। এর মধ্যে ঘর তৈরি, খাবার, বাচ্চা কেনা ও ওষুধের খরচ অন্তর্ভুক্ত।
প্রশ্ন ৩: দেশি মুরগির ব্যবসা থেকে আয় কেমন হয়?
উত্তর: সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে প্রতি ১০০টি মুরগি থেকে বছরে ১.৫–২ লাখ টাকার মতো আয় করা যায়। ডিম বিক্রি, মাংস বিক্রি ও বাচ্চা বিক্রি — এই তিন উৎস থেকেই ভালো লাভ পাওয়া যায়।
প্রশ্ন ৮: এই খামারের জন্য কত জায়গা প্রয়োজন?
উত্তর: প্রতি ১০০টি মুরগির জন্য কমপক্ষে ৩০০–৪০০ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল ও আলো থাকা জরুরি।
প্রশ্ন ১০: নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ কী?
উত্তর: শুরুতে ছোট পরিসরে শুরু করুন, অভিজ্ঞ খামারিদের পরামর্শ নিন, খামার ব্যবস্থাপনা শেখার চেষ্টা করুন এবং নিয়মিত রেকর্ড রাখুন,আধুনিক খামার দেখে পরিকল্পনা করুন— এতে দ্রুত লাভবান হওয়া সম্ভব।

উপসংহার

দেশি মুরগি খামার একটি লাভজনক, নিরাপদ এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা। সঠিক পরিকল্পনা, খাদ্য ও পানি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং বাজারজাতকরণের মাধ্যমে আপনি সহজেই লাখ টাকার আয় করতে পারেন। ধৈর্য, নিয়মিত পরিচর্যা এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারই সফলতার চাবিকাঠি।

আপনি যদি সত্যিই ছোট আকারে ব্যবসা করতে চান, দেশি মুরগি খামার শুরু করাই সেরা পছন্দ।


"দেশি মুরগি খামার শুরু করার গাইডের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন”

📩জিমেইলঃ  malaminkrisokkrishi@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কৃষক🔆কৃষি আপনাকে স্বাগতম
আসসালামু আলাইকুম ! কিভাবে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি?
Type here...